ডিএনএস (DNS) কী এবং কীভাবে কাজ করে? ইন্টারনেটের অদৃশ্য গ্রন্থাগারিকের গল্প

0


ভূমিকা: এক মহাজ্ঞানের গ্রন্থাগার কল্পনা করুন, ইন্টারনেট হলো এক অসীম, মহাজাগতিক গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরিতে রয়েছে কোটি কোটি বই (ওয়েবসাইট)। প্রতিটি বইয়ের একটি নিজস্ব, অনন্য শেলফ নম্বর বা 'কল নম্বর' আছে, যা দিয়ে তাকে খুঁজে বের করা যায়। কিন্তু এই নম্বরগুলো মানুষের মনে রাখার মতো নয়। এগুলো হলো 172.217.16.14 (Google) বা 104.18.30.33 (Probashitime) এর মতো জটিল এবং অর্থহীন সংখ্যার সারি। এই নম্বরগুলোকে বলা হয় আইপি অ্যাড্রেস (IP Address)।

এখন ভাবুন, আপনি যদি এই লাইব্রেরিতে প্রবেশ করে আপনার প্রিয় বই "ফেসবুক" পড়তে চান, তাহলে আপনাকে কি 157.240.22.35 এই নম্বরটি মনে রাখতে হবে? এটি প্রায় অসম্ভব।

ঠিক এখানেই আবির্ভূত হন আমাদের গল্পের নায়ক—এক নীরব, সর্বজ্ঞ এবং অবিশ্বাস্যরকমের দ্রুতগতির 'প্রধান গ্রন্থাগারিক'। তার নাম ডিএনএস (DNS) বা ডোমেইন নেম সিস্টেম। ডিএনএস হলো ইন্টারনেটের সেই জাদুকরী ব্যবস্থা, যা আমাদের মানুষের বোধগম্য নামগুলোকে (যেমন: google.com) মেশিনের বোধগম্য আইপি অ্যাড্রেসে (যেমন: 172.217.16.14) অনুবাদ করে দেয়। এটিই হলো ইন্টারনেটের অদৃশ্য কিন্তু অপরিহার্য 'ফোনবুক'। চলুন, এই গ্রন্থাগারিকের কর্মযজ্ঞের গভীরে প্রবেশ করা যাক।

অনুসন্ধানের যাত্রা: একটি বই খুঁজে বের করার প্রক্রিয়া যখন আপনি আপনার ব্রাউজারের অ্যাড্রেস বারে probashitime.com লিখে এন্টার চাপেন, তখন আপনি আসলে প্রধান গ্রন্থাগারিক বা ডিএনএস-কে একটি অনুরোধ পাঠান। আপনার ব্রাউজার (এখানে 'অনুসন্ধানী') ডিএনএস-কে জিজ্ঞেস করে, "হে গ্রন্থাগারিক, 'https://www.google.com/url?sa=E&source=gmail&q=probashitime.com' নামক বইটি কোন শেলফে রাখা আছে?"

এই সহজ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য, ডিএনএস পর্দার আড়ালে এক অবিশ্বাস্যরকমের দ্রুত এবং জটিল অনুসন্ধান প্রক্রিয়া চালায়।

  • ধাপ ১: ব্যক্তিগত নোটবুক পরীক্ষা (ব্রাউজার এবং ওএস ক্যাশে):

    • গ্রন্থাগারিক প্রথমে তার নিজের স্মৃতি বা ব্যক্তিগত নোটবুক (যাকে বলা হয় 'ক্যাশে' - Cache) পরীক্ষা করে দেখেন। আপনি যদি কিছুক্ষণ আগেও probashitime.com ওয়েবসাইটটি ভিজিট করে থাকেন, তাহলে তার আইপি অ্যাড্রেসটি গ্রন্থাগারিকের স্মৃতিতে থেকে যায়। যদি তাই হয়, তাহলে সে সাথে সাথেই আপনাকে সঠিক শেলফ নম্বরটি (104.18.30.33) বলে দেয় এবং আপনার অনুসন্ধান সেখানেই শেষ হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াটি ঘটে মিলি-সেকেন্ডেরও কম সময়ে।

  • ধাপ ২: সেন্ট্রাল ডেস্কে জিজ্ঞাসা (রিকার্সিভ ডিএনএস সার্ভার):

    • যদি গ্রন্থাগারিকের ব্যক্তিগত স্মৃতিতে তথ্যটি না থাকে, তাহলে সে তার পরবর্তী ডেস্কে, অর্থাৎ আপনার ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (ISP) কর্তৃক নির্ধারিত 'রিকার্সিভ ডিএনএস সার্ভার'-এর কাছে অনুরোধটি পাঠায়। এই সার্ভারটি হলো আপনার এলাকার শাখা গ্রন্থাগারিকের মতো, যার কাজ হলো আপনার জন্য তথ্যটি খুঁজে বের করে আনা। এখন, এই শাখা গ্রন্থাগারিক তার নিজের অনুসন্ধান শুরু করে।

  • ধাপ ৩: প্রধান মহাফেজখানায় যোগাযোগ (রুট সার্ভার):

    • শাখা গ্রন্থাগারিক প্রথমে যোগাযোগ করে বিশ্বের ১৩টি 'রুট সার্ভার'-এর যেকোনো একটির সাথে। এই রুট সার্ভারগুলো হলো পুরো ইন্টারনেট লাইব্রেরি সিস্টেমের প্রধান মহাফেজখানা বা 'হেড লাইব্রেরিয়ান'। তারা প্রতিটি বইয়ের সঠিক অবস্থান জানে না, কিন্তু তারা জানে কোন ধরনের বইয়ের জন্য কোন বিভাগের লাইব্রেরিয়ানের কাছে যেতে হবে।

    • রুট সার্ভার probashitime.com-এর .com অংশটি দেখে বলে, "আমি ঠিক জানি না এই বইটি কোথায়, কিন্তু তুমি '.com' বিভাগের লাইব্রেরিয়ানের কাছে যাও। তার কাছে সমস্ত .com বইয়ের তালিকা আছে।"

  • ধাপ ৪: নির্দিষ্ট বিভাগে অনুসন্ধান (TLD নেম সার্ভার):

    • এবার, শাখা গ্রন্থাগারিক রুট সার্ভারের নির্দেশনা অনুযায়ী '.com' টপ-লেভেল ডোমেইন (TLD) নেম সার্ভারের কাছে যায়। এই TLD সার্ভারটি হলো লাইব্রেরির '.com' সেকশনের দায়িত্বে থাকা বিভাগীয় প্রধান।

    • সে তার তালিকা দেখে বলে, "হ্যাঁ, 'https://www.google.com/url?sa=E&source=gmail&q=probashitime.com' নামক বইটি আমার তালিকায় আছে। এই বইটির প্রকাশকের (Authoritative Name Server) ঠিকানা হলো অমুক।"

  • ধাপ ৫: প্রকাশকের কাছ থেকে চূড়ান্ত তথ্য (অথরিটেটিভ নেম সার্ভার):

    • সবশেষে, শাখা গ্রন্থাগারিক সেই নির্দিষ্ট 'অথরিটেটিভ নেম সার্ভার'-এর কাছে যায়। এটিই হলো সেই সার্ভার, যেখানে probashitime.com ওয়েবসাইটটি হোস্ট করা আছে—অর্থাৎ, এটি হলো বইটির আসল প্রকাশক।

    • এই সার্ভারটিই চূড়ান্ত এবং সঠিক উত্তরটি দেয়: "'https://www.google.com/url?sa=E&source=gmail&q=probashitime.com' বইটির শেলফ নম্বর হলো 104.18.30.33।"

শাখা গ্রন্থাগারিক (রিকার্সিভ সার্ভার) এই উত্তরটি পাওয়ার পর, সেটিকে নিজের স্মৃতিতে (ক্যাশে) কিছু সময়ের জন্য সংরক্ষণ করে রাখে এবং তারপর উত্তরটি আপনার ব্রাউজারকে পাঠিয়ে দেয়। আপনার ব্রাউজার এবার সঠিক শেলফ নম্বর বা আইপি অ্যাড্রেসটি ব্যবহার করে সেই সার্ভারের সাথে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করে এবং আপনার সামনে ওয়েবসাইটটি লোড হয়ে যায়।

এই পুরো জটিল প্রক্রিয়াটি—আপনার ব্রাউজার থেকে শুরু করে রুট সার্ভার, TLD সার্ভার, এবং অথরিটেটিভ সার্ভার হয়ে আবার আপনার ব্রাউজারে ফিরে আসা—সাধারণত এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়।

লাইব্রেরির নিরাপত্তা এবং গতি বাড়ানোর কৌশল

  • ডিএনএস স্পুফিং (DNS Spoofing): মাঝে মাঝে, কিছু দুষ্টু 'ছদ্মবেশী গ্রন্থাগারিক' (হ্যাকার) আপনার অনুসন্ধানের পথে বাধা দিয়ে আপনাকে একটি ভুল শেলফ নম্বর দিয়ে দিতে পারে। অর্থাৎ, আপনি যেতে চেয়েছিলেন আপনার ব্যাংকের ওয়েবসাইটে, কিন্তু আপনাকে নিয়ে যাওয়া হলো একটি নকল ফিশিং সাইটে।

  • ডিএনএসএসইসি (DNSSEC): এই নিরাপত্তা প্রোটোকলটি অনেকটা প্রতিটি তথ্যের উপর একটি ডিজিটাল 'সীলমোহর' লাগানোর মতো কাজ করে, যা নিশ্চিত করে যে আপনি সঠিক গ্রন্থাগারিকের কাছ থেকেই সঠিক তথ্যটি পাচ্ছেন।

  • পাবলিক ডিএনএস ব্যবহার: আপনার ISP-র দেওয়া ডিএনএস সার্ভার অনেক সময় ধীরগতির বা কম সুরক্ষিত হতে পারে। আপনি চাইলে আপনার ডিভাইসের ডিএনএস সেটিং পরিবর্তন করে গুগলের (8.8.8.8) বা ক্লাউডফ্লেয়ারের (1.1.1.1) মতো দ্রুত এবং সুরক্ষিত পাবলিক ডিএনএস সার্ভার ব্যবহার করতে পারেন। এটি অনেকটা একজন আরও অভিজ্ঞ এবং দ্রুতগতির গ্রন্থাগারিকের সাহায্য নেওয়ার মতো।

ডিএনএস হলো ইন্টারনেটের সেই নীরব নায়ক, যার ছাড়া এই বিশাল তথ্যভান্ডারটি ব্যবহার করা আমাদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে যেত। এটি সেই অদৃশ্য কিন্তু অপরিহার্য ব্যবস্থা, যা আমাদের একটি সহজ ক্লিকের মাধ্যমে, চোখের পলকে, কোটি কোটি ওয়েবসাইটের সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে দেয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!