ভূমিকা: ভক্তি থেকে বিতর্ক
"হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে..."—এই মন্ত্রটি আজ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি বড় শহরেই পরিচিত। সাদা ও গেরুয়া বসন পরিহিত, মৃদঙ্গ ও করতাল বাজিয়ে একদল অনুসারীর এই ভক্তিগীতি আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ বা ইসকনের (ISKCON) প্রধান পরিচয়। ১৯৬৬ সালে নিউইয়র্কে অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের হাত ধরে যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, তা আজ এক বিশ্বব্যাপী সংগঠনে পরিণত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে এর কয়েকশ মন্দির, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রেস্তোরাঁ এবং লক্ষ লক্ষ অনুসারী রয়েছে।
বাইরে থেকে দেখলে এটিকে একটি ভক্তিমূলক, অহিংস এবং নিরামিষাশী আধ্যাত্মিক আন্দোলন বলে মনে হয়। কিন্তু এই আপাত শান্ত চেহারার আড়ালে লুকিয়ে আছে গভীর বিতর্ক, অন্ধকার অতীত এবং জটিল ভূ-রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ। বিশ্বব্যাপী এটিকে অনেকে ‘কাল্ট’ বা এক ধরনের ধর্মীয় উপদল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এর বিরুদ্ধে উঠেছে শিশু নির্যাতন, আর্থিক অনিয়ম এবং উগ্র ধর্মীয় মতবাদ প্রচারের মতো গুরুতর সব অভিযোগ।
বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষত ভারত ও বাংলাদেশে, ইসকনের কার্যক্রম প্রায়ই রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়ীক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। অনেকেই অভিযোগ করেন যে, এটি নিছক একটি আধ্যাত্মিক সংগঠন নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা। এই প্রতিবেদনে আমরা ইসকনের উত্থান থেকে শুরু করে এর বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন গুরুতর অভিযোগ এবং এর কার্যক্রমের "ভয়াবহতা" নিয়ে একটি গভীর অনুসন্ধান চালাব।
অধ্যায় ১: উত্থানের গল্প - একজন স্বামীর নিউইয়র্ক যাত্রা
ইসকনের শক্তি ও দুর্বলতা বুঝতে হলে এর প্রতিষ্ঠাতার দর্শনকে বোঝা জরুরি। অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ ভারতে গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদ অধ্যয়ন করেন। তার গুরু তাকে পশ্চিমা বিশ্বে কৃষ্ণভক্তি প্রচারের নির্দেশ দেন। ১৯৬৬ সালে, প্রায় ৭০ বছর বয়সে, তিনি আক্ষরিক অর্থেই শূন্য হাতে নিউইয়র্কে পৌঁছান।
সে সময়টা ছিল আমেরিকার জন্য এক অস্থির সময়। ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন, হিপি সংস্কৃতি এবং প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক ধরনের বিদ্রোহ চলছিল। প্রভুপাদ এই সুযোগটিই গ্রহণ করেন। তিনি নিউইয়র্কের এক পার্কে বসে হরে কৃষ্ণ মন্ত্র জপ শুরু করেন। তার এই সহজ ভক্তিযোগ, বর্ণময় সংস্কৃতি এবং মাদকবিরোধী কঠোর অবস্থান অনেক আমেরিকান তরুণ-তরুণীকে আকর্ষণ করে, যারা সে সময়ের প্রচলিত ভোগবাদী জীবনের বিপরীতে এক নতুন অর্থ খুঁজছিল।
এই পশ্চিমা অনুসারীদের হাত ধরেই ইসকন দ্রুত ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া এবং বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের মূল দর্শন ছিল ভগবত গীতা এবং শ্রীমদ ভাগবতমের উপর ভিত্তি করে কৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান হিসেবে পূজা করা এবং ভক্তিযোগের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক মুক্তি অর্জন।
অধ্যায় ২: অন্ধকারের অতীত - 'কাল্ট' বিতর্ক এবং শিশু নির্যাতনের ভয়াবহ অভিযোগ
ইসকনের জনপ্রিয়তা বাড়ার সাথে সাথেই এর বিরুদ্ধে প্রথম যে অভিযোগটি জোরালোভাবে উঠতে শুরু করে তা হলো এটি একটি ‘কাল্ট’ (Cult)। সমালোচকরা অভিযোগ করেন, ইসকন তরুণ-তরুণীদের ‘ব্রেইনওয়াশ’ বা মগজ ধোলাই করে তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, তাদের সমস্ত সম্পত্তি সংগঠনের নামে লিখিয়ে নেয় এবং একটি কঠোর, বিচ্ছিন্ন জীবনযাপনে বাধ্য করে।
তথ্যসূত্র: আশির দশকে পশ্চিমা গণমাধ্যমে ইসকনকে প্রায়ই একটি "ডেস্ট্রাকটিভ কাল্ট" হিসেবে বর্ণনা করা হতো, যা তার সদস্যদের উপর অতিনিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। (সূত্র: The Washington Post archives, "The Dark Side of the Hare Krishnas")*
তবে ইসকনের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়টি হলো এর আবাসিক বিদ্যালয় বা ‘গুরুকুল’-এ শিশুদের উপর চালানো ভয়াবহ নির্যাতন।
১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশকে, ইসকনের নেতারা তাদের অনুসারীদের সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণভক্তির জন্য উৎসর্গ করতে বলতেন। এর অংশ হিসেবে, সদস্যদের তাদের ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদেরকেও সংগঠনের পরিচালিত বোর্ডিং স্কুল বা গুরুকুলগুলোতে পাঠিয়ে দিতে উৎসাহিত করা হতো, যাতে তারা জাগতিক মায়া থেকে মুক্ত হয়ে বড় হতে পারে।
কিন্তু এই গুরুকুলগুলো পরিণত হয়েছিলো এক একটি নির্যাতন কেন্দ্রে। পরবর্তীতে, শত শত সাবেক শিক্ষার্থী মুখ খোলেন। তারা অভিযোগ করেন যে, এই স্কুলগুলোতে তাদের উপর নিয়মিতভাবে শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতন চালানো হয়েছে। তাদের পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হতো না, সামান্য ভুলের জন্য নির্মমভাবে প্রহার করা হতো এবং অনেক শিশুকেই শিক্ষকের পদে থাকা সিনিয়র ভক্তদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে।
২০০০ সালে, ৯২ জন সাবেক গুরুকুল শিক্ষার্থী ইসকনের বিরুদ্ধে $৪০০ মিলিয়ন ডলারের এক বিশাল মামলা দায়ের করেন। এই মামলাটি বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
তথ্যসূত্র: হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির "প্লুরালিজম প্রজেক্ট" আর্কাইভ অনুযায়ী, ইসকন এই অভিযোগগুলোর সত্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ২০০৫ সালে $৯.৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ৪৫০ জনেরও বেশি নির্যাতিতের সাথে মামলার নিষ্পত্তি বা সেটেলমেন্ট করে। (সূত্র: Harvard University Pluralism Project Archive, "ISKCON Abuse Cases Settled for USD 9.5 Million")*
ইসকন কর্তৃপক্ষ পরবর্তীতে একটি "চাইল্ড প্রটেকশন অফিস" তৈরি করে এবং এই ঘটনাগুলোকে "বিচ্যুতি" হিসেবে আখ্যায়িত করে। কিন্তু সমালোচকরা বলেন, এই নির্যাতন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, বরং এটি ছিল সংগঠনের সেই সময়ের মতাদর্শের একটি প্রত্যক্ষ ফলাফল, যা শিশুদের "মায়ার বন্ধন" হিসেবে দেখতো।
অধ্যায় ৩: "ভারতের দুষ্ট চক্র?" - রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও উগ্র মতবাদের অভিযোগ
আপনার উল্লেখিত "ভারতের একটি দুষ্ট চক্র" কথাটি মূলত ইসকনের বিরুদ্ধে ওঠা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগের দিকেই ইঙ্গিত করে। যদিও ইসকন নিজেদেরকে একটি অরাজনৈতিক এবং শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক সংগঠন হিসেবে দাবি করে, সমালোচকরা, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায়, এর কার্যক্রমকে ভিন্ন চোখে দেখেন।
ক) হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সাথে সখ্যতা:
সমালোচকরা প্রায়শই ইসকনকে ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী বা হিন্দু জাতীয়তাবাদী (Hindutva) আন্দোলনের একটি "সফট পাওয়ার" বা কোমল রূপ হিসেবে অভিযুক্ত করেন। তাদের মতে, ইসকন পশ্চিমা বিশ্বে হিন্দুধর্মের একটি নির্দিষ্ট সংস্করণ প্রচারের মাধ্যমে হিন্দু জাতীয়তাবাদী এজেন্ডাকেই প্রকারান্তরে বৈধতা দেয়।
তথ্যসূত্র: ভারতে ইসকনের কার্যক্রম প্রায়ই মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। বিশেষ করে, তাদের প্রতিষ্ঠিত "অক্ষয় পাত্র ফাউন্ডেশন" (Akshaya Patra Foundation) নামক দাতব্য সংস্থাটি ভারতে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম মিড-ডে মিল (স্কুল লাঞ্চ) প্রোগ্রাম পরিচালনা করে, যা বিভিন্ন রাজ্য সরকারের সাথে যৌথভাবে পরিচালিত হয়। (সূত্র: The Wire India, "Explainer: The Allegations Against Akshaya Patra")*
খ) অক্ষয় পাত্রের বিতর্ক - সেবার আড়ালে এজেন্ডা?
ইসকনের এই সেবা কার্যক্রমও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। অক্ষয় পাত্র ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, তারা ধর্মীয় বিশ্বাসের অজুহাতে স্কুলশিশুদের খাবার থেকে পেঁয়াজ, রসুন এবং ডিম বাদ দেয়। সমালোচক এবং পুষ্টিবিদরা বলছেন, ডিম প্রোটিনের একটি সস্তা এবং গুরুত্বপূর্ণ উৎস, যা বাদ দেওয়ায় দরিদ্র শিশুদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ ব্যাহত হচ্ছে।
তথ্যসূত্র: ভারতের কর্ণাটকসহ বিভিন্ন রাজ্যের শিক্ষাবিদ ও অ্যাক্টিভিস্টরা এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, ইসকন তাদের "উচ্চ-বর্ণের" ধর্মীয় খাদ্যাভ্যাস শিশুদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে, যা ভারতের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির পরিপন্থী। (সূত্র: Scroll.in, "Explainer: Does Akshaya Patra actually serve midday meals...?")*
এই ঘটনাগুলোই "দুষ্ট চক্র" বা "এজেন্ডা" ভিত্তিক সংগঠন হিসেবে ইসকনের সমালোচনাকে வலுদার করে।
অধ্যায় ৪: আন্তঃধর্মীয় সংঘাত এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
আপনার উদ্বেগের মূল বিষয়—"ইসলামের উপরে তাদের প্রিপ্ল্যান শত্রুতা"—এই অভিযোগটি বিশেষভাবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রায়ই আলোচিত হয়। যদিও ইসকন আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে শত্রুতার কথা বলে না, তবে বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে তাদের কার্যক্রম, জমি অধিগ্রহণ এবং মন্দির স্থাপনকে কেন্দ্র করে প্রায়ই তীব্র সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছে।
ক) ২০২১ সালের নোয়াখালী সহিংসতা: যে ঘটনাটি বিতর্কের কেন্দ্রে:
এই অভিযোগটি সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে ২০২১ সালের দুর্গাপূজার সময়। কুমিল্লায় পবিত্র কোরআন অবমাননার একটি গুজবকে কেন্দ্র করে যখন সারা দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, তখন এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় নোয়াখালীর চৌমুহনীতে অবস্থিত ইসকন মন্দির।
তথ্যসূত্র: আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো, যেমন The Times of India এবং India Today-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের ১৫ই অক্টোবর এক বিশাল জনতা নোয়াখালীর ইসকন মন্দিরে হামলা চালায়। এই হামলায় ইসকনের দুজন ভক্ত, পার্থ দাস এবং যতন সাহা, নির্মমভাবে নিহত হন এবং মন্দিরটি ব্যাপকভাবে ভাঙচুর করা হয়। (সূত্র: The Times of India, "1 dead in attack by mob at ISKCON temple in Bangladesh's Noakhali")*
খ) দুটি পরস্পরবিরোধী বয়ান:
এই ঘটনার পর দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বয়ান সামনে আসে, যা ইসকনকে ঘিরে থাকা বিতর্ককে আরও জটিল করে তোলে:
ইসকনের বয়ান: ইসকনের পক্ষ থেকে এই হামলাকে বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর চালানো পরিকল্পিত গণহত্যার অংশ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। তারা বিশ্বব্যাপী এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং বাংলাদেশ সরকারের কাছে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দাবি করে। তাদের মতে, তারা নিছকই ধর্মীয় আচার-পালনকারী একটি নিরীহ সংগঠন, যারা উগ্র ইসলামপন্থীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। (সূত্র: India Today, "ISKCON urges Bangladesh govt to ensure safety of minorities...")*
স্থানীয় এবং সমালোচকদের বয়ান: অন্যদিকে, স্থানীয়দের এবং কিছু সমালোচকের বয়ান ছিল ভিন্ন। কিছু গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে আসে যে, নোয়াখালীর ওই মন্দিরটি একটি বিতর্কিত জমিতে অবস্থিত ছিল এবং ইসকনের কিছু কার্যক্রমকে স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায় "আগ্রাসী" এবং "উস্কানিমূলক" হিসেবে দেখছিল। যদিও এটি কোনোভাবেই তাকে ন্যায্যতা দেয় না, তবে সমালোচকরা বলেন যে, ইসকনের কার্যক্রম প্রায়ই স্থানীয় সম্প্রদায়ের সাথে সংঘর্ষের পথ তৈরি করে।
গ) "শত্রুতা"-এর অভিযোগ:
আপনার উল্লেখিত "ইসলামের প্রতি শত্রুতা"র অভিযোগটি মূলত এখান থেকেই উৎসারিত। সমালোচকদের একটি অংশ মনে করে, ইসকন উদ্দেশ্যমূলকভাবে মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোতে তাদের উপস্থিতি জানান দেয়, যা এক ধরনের ধর্মীয় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা এবং যা প্রায়শই সাম্প্রদায়িক সংঘাতের জন্ম দেয়। তারা ইসকনের কার্যক্রমকে ভারতীয় রাজনৈতিক এজেন্ডার একটি বর্ধিত অংশ হিসেবে দেখেন।
তবে, এটি একটি অত্যন্ত জটিল এবং স্পর্শকাতর বিষয়। ইসকন বরাবরই নিজেদেরকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে এবং সহিংসতার শিকার হিসেবে দাবি করে, যখন সমালোচকরা তাদেরকেই উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য দায়ী করেন।
অধ্যায় ৫: উপসংহার - একটি জটিল বাস্তবতা
ইসকনকে একটি সরলরৈখিক "সাদা" বা "কালো" সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করা কঠিন।
এর লক্ষ লক্ষ অনুসারীর কাছে, এটি একটি জীবন পরিবর্তনকারী আধ্যাত্মিক পথ, যা তাদের মাদক এবং ভোগবাদ থেকে মুক্ত করে এক শুদ্ধ জীবনের সন্ধান দিয়েছে। এর দাতব্য কার্যক্রম, বিশেষ করে খাদ্য বিতরণ (যেমন অক্ষয় পাত্র), লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছে।
কিন্তু এর মুদ্রার অপর পিঠটিও ভয়াবহ। একটি সংগঠন যার ইতিহাস ভয়াবহ শিশু নির্যাতনের কলঙ্কে কলঙ্কিত, যার বিরুদ্ধে "কাল্ট" হিসেবে মগজ ধোলাইয়ের অভিযোগ রয়েছে, এবং যার কার্যক্রম প্রায়শই রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার কেন্দ্রেবিন্দুতে থাকে—তাকে নিছক একটি "আধ্যাত্মিক আন্দোলন" হিসেবে দেখাটা হবে সরলীকরণ।
বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অত্যন্ত ভঙ্গুর, সেখানে ইসকনের মতো একটি সংগঠনের কার্যক্রম অনেক বেশি স্বচ্ছতা এবং স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি সংবেদনশীলতা দাবি করে। অন্যথায়, ভক্তি প্রচারের এই আন্দোলন খুব সহজেই সংঘাতের অগ্নিস্ফুলিঙ্গে পরিণত হতে পারে, যেমনটি আমরা অতীতে দেখেছি। ইসকনের "ভয়াবহতা" তার দর্শনে নয়, বরং এর প্রয়োগ, অস্বচ্ছতা এবং প্রায়শই উগ্র প্রতীয়মান হওয়া সাংগঠনিক আচরণের মধ্যেই নিহিত।
