মিনাস গেরাইস, ব্রাজিল। ভোরের কুয়াশা তখনও কফি গাছের সবুজ পাতাগুলোকে আলতো করে ভিজিয়ে রেখেছে। মারিয়া ডি সুজা, তার রুক্ষ কিন্তু অভিজ্ঞ হাত দিয়ে, পাকা, টকটকে লাল কফি চেরিগুলো একটি একটি করে তুলছেন। তার কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম, আর চোখে এক ধরনের শান্ত নিবেদন। এই একটি চেরির ভেতরেই লুকিয়ে আছে দুটি বীজ বা 'বিন'—যা হয়তো কয়েক সপ্তাহ পর, হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে, কুয়েত সিটির কোনো এক আধুনিক ক্যাফেতে আপনার সকালের কাপটিকে সুগন্ধে ভরিয়ে তুলবে।
আমরা যখন এক কাপ কফির জন্য ৪-৫ ডলার বা ২ দিনার খরচ করি, তখন আমরা হয়তো এর স্বাদ বা গন্ধ নিয়েই ভাবি। কিন্তু আমরা প্রায়শই সেই অদৃশ্য নেটওয়ার্কটির কথা ভুলে যাই, যা এই সাধারণ পানীয়টিকে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক বাণিজ্যকৃত পণ্যে (তেলের পরেই) পরিণত করেছে। এটি কৃষক, রপ্তানিকারক, শিপিং লাইন, রোস্টার এবং বারিস্তাদের এক বিশাল এবং জটিল শৃঙ্খল। এটি মারিয়ার মতো মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের জীবিকার গল্প, এবং একই সাথে জলবায়ু পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের এক কঠিন বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।
চলুন, সেই একটি কফি বিনের সাথে আমরা এক বিশ্ব ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ি।
প্রথম পর্যায়: খামার থেকে বন্দরে—এক অনিশ্চিত ফসল মারিয়া ডি সুজা ব্রাজিলের 'সেরাডো মিনেইরো' অঞ্চলের একজন ক্ষুদ্র কফি চাষী। তার ছোট খামারটি সমবায় বা 'কো-অপারেটিভ'-এর অংশ। কফি চাষ একটি অত্যন্ত শ্রমসাধ্য এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজ।
জলবায়ু পরিবর্তনের খাঁড়া: গত কয়েক বছর ধরে, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং আকস্মিক তুষারপাত ব্রাজিলের কফি উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সামান্যতম আবহাওয়ার পরিবর্তনে পুরো বছরের ফসল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। মারিয়া জানালেন, "আগে আমরা জানতাম কখন বৃষ্টি হবে, কখন ফসল তুলতে হবে। এখন সবকিছুই অনিশ্চিত।"
ন্যায্য মূল্যের লড়াই: ফসল তোলার পর, মারিয়া এবং তার প্রতিবেশীরা তাদের কফি চেরিগুলো স্থানীয় কো-অপারেটিভের প্রসেসিং প্ল্যান্টে নিয়ে যান। সেখানে চেরিগুলো থেকে বীজ বা 'গ্রিন বিন' আলাদা করা হয়, শুকানো হয় এবং গ্রেডিং করা হয়। এই কো-অপারেটিভগুলো ক্ষুদ্র চাষীদের পক্ষ হয়ে আন্তর্জাতিক রপ্তানিকারকদের সাথে দর কষাকষি করে। কিন্তু নিউইয়র্ক বা লন্ডনের কমোডিটি মার্কেটে কফির দামের সামান্য ওঠানামাও মারিয়ার মতো কৃষকদের আয়ের উপর বিশাল প্রভাব ফেলে। অনেক সময়, তারা তাদের উৎপাদন খরচের চেয়েও কম দাম পান। 'ফেয়ার ট্রেড' (
) এর মতো সংস্থাগুলো এই কৃষকদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার জন্য কাজ করলেও, বিশ্ব কফি বাজারের একটি ক্ষুদ্র অংশই এর আওতাভুক্ত।Fair Trade Foundation
একবার গ্রেডিং এবং বস্তাবন্দী হওয়ার পর, মারিয়ার কফি বিনগুলো ট্রাকে করে ব্রাজিলের সান্তোস বন্দরের দিকে যাত্রা করে—যা বিশ্বের বৃহত্তম কফি রপ্তানি বন্দর।
দ্বিতীয় পর্যায়: মহাসাগরের উত্তাল ঢেউ—লজিস্টিকসের মহাযজ্ঞ সান্তোস বন্দরে, হাজার হাজার কফির বস্তা একটি বিশাল কন্টেইনার জাহাজে তোলা হয়। এই জাহাজটি এখন পাড়ি দেবে আটলান্টিক মহাসাগর।
সাপ্লাই চেইন সংকট: কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে, বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইন বা সরবরাহ শৃঙ্খল এক নজিরবিহীন সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। কন্টেইনারের অভাব, বন্দরের জট এবং জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি—এই সবকিছুই কফি পরিবহনের খরচ এবং সময় দুটোই বাড়িয়ে দিয়েছে। যে কফি বিন আগে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তার গন্তব্যে পৌঁছে যেত, তা এখন কয়েক মাস পর্যন্ত সময় নিতে পারে।
গুণগত মান রক্ষার চ্যালেঞ্জ: গ্রিন কফি বিনগুলো তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। দীর্ঘ সময় ধরে জাহাজের কন্টেইনারে আর্দ্র পরিবেশে থাকলে, কফির স্বাদ এবং গন্ধ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই, বিশেষায়িত এবং নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের কন্টেইনার ব্যবহার করা হয়, যা পরিবহন খরচ আরও বাড়িয়ে দেয়।
কয়েক সপ্তাহ বা মাসব্যাপী সমুদ্রযাত্রার পর, মারিয়ার কফি বিনগুলো পৌঁছায় দুবাইয়ের জেবেল আলী বন্দরের মতো কোনো এক আঞ্চলিক হাবে।
তৃতীয় পর্যায়: আগুন এবং শিল্পের ছোঁয়া—রোস্টিং জেবেল আলী বন্দর থেকে, সেই গ্রিন বিনগুলো হয়তো কুয়েতের কোনো এক স্থানীয় 'রোস্টারি' বা কফি ভাজাখানায় নিয়ে আসা হয়। এখানেই ঘটে আসল জাদু।
বিজ্ঞান এবং শিল্পের মেলবন্ধন: রোস্টিং হলো একটি শিল্প, যা বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে তৈরি। একজন 'মাস্টার রোস্টার' একটি বিশাল, উত্তপ্ত ড্রামের মধ্যে গ্রিন বিনগুলোকে ক্রমাগত ঘোরাতে থাকেন। সঠিক তাপমাত্রা এবং সময়ে, বিনগুলোর ভেতরে থাকা শর্করা এবং অ্যামিনো অ্যাসিডের মধ্যে এক রাসায়নিক বিক্রিয়া (Maillard Reaction) ঘটে, যা কফির সেই পরিচিত বাদামী রঙ এবং জটিল সুগন্ধ তৈরি করে।
স্বাদের প্রোফাইল: রোস্টিং-এর মাত্রার উপরই নির্ভর করে কফির চূড়ান্ত স্বাদ কেমন হবে। হালকা রোস্টে ফলের মতো 'অ্যাসিডিক' স্বাদ পাওয়া যায়, আর ডার্ক রোস্টে চকলেটের মতো 'তেতো' এবং শক্তিশালী স্বাদ পাওয়া যায়। রোস্টারকে জানতে হয়, ব্রাজিলের সেরাডো অঞ্চলের কফির জন্য কোন রোস্টিং প্রোফাইলটি সেরা।
চতুর্থ এবং চূড়ান্ত পর্যায়: বারিস্তার হাত—আপনার কাপে রোস্ট করা কফি বিনগুলো এবার পৌঁছে যায় আপনার প্রিয় কফি শপে। আপনি যখন একটি 'ল্যাটে' বা 'ক্যাপুচিনো' অর্ডার করেন, তখন শুরু হয় এই যাত্রার শেষ এবং সবচেয়ে শৈল্পিক ধাপটি।
গ্রাইন্ডিং এবং ব্রিউইং: একজন দক্ষ বারিস্তা ঠিক আপনার অর্ডার দেওয়ার পরই বিনগুলোকে গ্রাইন্ড করেন, যাতে এর সুগন্ধ অটুট থাকে। এরপর, তিনি এস্প্রেসো মেশিনের মাধ্যমে উচ্চচাপে গরম পানি প্রবাহিত করে মাত্র ২৫-৩০ সেকেন্ডের মধ্যে কফির একটি ঘন এবং সুগন্ধময় নির্যাস বা 'শট' তৈরি করেন।
চূড়ান্ত পরিবেশন: এই এস্প্রেসো শটের সাথে নিখুঁতভাবে স্টিম করা দুধ মিশিয়ে এবং তার উপরে একটি সুন্দর 'ল্যাটে আর্ট' এঁকে, বারিস্তা আপনার হাতে তুলে দেন সেই উষ্ণ কাপটি।
একটি বৃত্তের সমাপ্তি আপনার এক কাপ কফির এই দীর্ঘ যাত্রাটি, যা শুরু হয়েছিল ব্রাজিলের এক প্রত্যন্ত গ্রামের মারিয়ার হাত ধরে, তা শেষ হলো আপনার হাতে এসে। এই যাত্রাপথে, এটি অন্তত দশটি ভিন্ন হাত এবং চারটি ভিন্ন মহাদেশ স্পর্শ করেছে।
এই গল্পের গভীরে রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমরা কি আমাদের কফির জন্য ন্যায্য মূল্য পরিশোধ করছি? যে কৃষক এই পুরো শৃঙ্খলের ভিত্তি, সে কি তার পরিশ্রমের সঠিক মর্যাদা পাচ্ছে? জলবায়ু পরিবর্তন কি ভবিষ্যৎ। আমাদের এই প্রিয় পানীয়টিকে একটি বিলাসবহুল পণ্যে পরিণত করবে?
তাই, পরেরবার যখন আপনি আপনার সকালের কফিতে চুমুক দেবেন, তখন একবারের জন্য হলেও সেই দীর্ঘ এবং অদৃশ্য শৃঙ্খলটির কথা ভাববেন। ভাববেন মারিয়ার কথা, এবং সেই মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের কথা, যাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া আপনার সকালটা হয়তো এত সুগন্ধময় হতো না।