ট্রাক্টরের প্রেমকাহিনি

0

চরগাঁও গ্রামে মানুষ যতটা রাজনীতি বোঝে, তার থেকে বেশি বোঝে দুই জিনিস— ধান কাটার মৌসুম আর নতুন ট্রাক্টরের দাম। গ্রামের মোড়ের চায়ের দোকানে যদি সকাল থেকে সন্ধ্যা বসে থাকেন, অন্তত দশবার শুনবেন— “এই যে হোসেন আলীর ট্রাক্টরটা, গিয়ার আটকে গেছে”, “ওই যে কালাম মোল্লার ট্রাক্টর, বাঁশঝাড়ে ঢুকে পড়েছে”, “ট্রাক্টরের ইঞ্জিন গরম হলে কিভাবে ঠাণ্ডা করতে হয় জানিস?” ইত্যাদি।

ঠিক সেই গ্রামে একদিন হাজির হলো একেবারে নতুন ট্রাক্টর। চকচকে লাল রঙের, সামনে সোনালি অক্ষরে লেখা— “হৃদয়-৭২০”। মালিক হলো সদ্য দুবাই ফেরত কুদ্দুস। বিদেশে দশ বছর ইট-সিমেন্ট বয়ে এই টাকা জমিয়েছে, এখন দেশে এসে ট্রাক্টর কিনেই নাকি ভবিষ্যত গড়ে তুলবে।

কুদ্দুস এমনভাবে ট্রাক্টর কিনে বাড়ির উঠানে রাখল, যেন সে আইফেল টাওয়ার কিনে এনেছে। ট্রাক্টর ঢাকা থাকল নতুন নীল ত্রিপল দিয়ে, যেন বৃষ্টি-রোদ কোনোদিন স্পর্শ করতে না পারে। গ্রামে কেউ বেড়াতে এলে প্রথমেই দেখানো হয়— “আরে, চলেন আমার হৃদয়-৭২০ দেখি।”

এমনকি কুদ্দুস রাতে ঘুমানোর আগে পাঁচবার ট্রাক্টরের হর্ন বাজিয়ে আশ্বস্ত হয়, “আহা, বেঁচে আছিস তো, আমার সোনা?”

গ্রামের ছেলেপেলেরা ট্রাক্টর ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে, আঙুল দিয়ে ছুঁতে গেলে কুদ্দুস ধমক দেয়, “হাত দিস না! এটা কোনো সাধারণ ট্রাক্টর না, এ আমার প্রাণ।”

কিন্তু সমস্যা হলো— ট্রাক্টর যতই দামি হোক, চালক ছাড়া সে একেবারেই অকেজো। কুদ্দুসের নিজের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই, গাড়ি চালানো তো দূরের কথা, সাইকেল চালালেও মাঝেমাঝে ডানে-বাঁয়ে পড়ে যায়। ফলে তাকে চালক ভাড়া করতে হলো।

এবার মঞ্চে ঢুকল আমাদের গ্রামের বিখ্যাত চালক— বাদল। বাদল যখন ট্রাক্টর চালায়, মনে হয় সে মঞ্চে নাটক করছে। গামছা মাথায় বেঁধে, গলায় গান গেয়ে, ডানে-বাঁয়ে নাচতে নাচতে সে ট্রাক্টর চালায়। গ্রামের মেয়েরা জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখে, “আহা, বাদল কেমন হ্যান্ডেল ঘোরাচ্ছে!”

প্রথমদিন বাদল যখন কুদ্দুসের হৃদয়-৭২০ নিয়ে ধানক্ষেতে ঢুকল, পুরো গ্রাম ছুটে গেল দেখতে। যেন সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। বাদল গর্ব করে বলল, “এই ট্রাক্টর দিয়ে আমি এক দিনে পুরো মাঠ চাষ করে ফেলব।”

কিন্তু ট্রাক্টরেরও নিজের মর্জি আছে। সে হঠাৎ করে বাঁদিকে ঘুরে যায়, কখনো গর্তে নেমে যায়, কখনো পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। বাদল যতই হর্ন বাজায়, ট্রাক্টর থামে না।

একদিন তো এমন অবস্থা হলো— ট্রাক্টর একেবারে মসজিদের বারান্দায় ঢুকে পড়ল! মসজিদের ইমাম সাহেব অবাক হয়ে বললেন, “এ কেমন জানোয়ার রে ভাই, আজান শোনার জন্য ভেতরে ঢুকে পড়ল নাকি?”

গ্রামজুড়ে হাসাহাসি। কুদ্দুস কপালে হাত দিয়ে বসে আছে।

তবে সবচেয়ে মজার ঘটনা ঘটল পরের সপ্তাহে। কুদ্দুসের ট্রাক্টর নাকি প্রেমে পড়েছে!

শোনে তো গ্রামের সবাই হাঁ করে গেল। ব্যাপারটা হলো— পাশের গ্রামে করিম মাস্টারের আরেকটা ট্রাক্টর আছে, নাম দিয়েছে “লক্ষ্মী-৫০০”। সেটাও সবুজ রঙের, একেবারে ময়ূরের মতো চকচকে।

একদিন কুদ্দুসের হৃদয়-৭২০ আর করিম মাস্টারের লক্ষ্মী-৫০০ বাজারে মুখোমুখি হলো। হঠাৎ হৃদয়-৭২০ এমনভাবে হর্ন বাজাতে শুরু করল, মনে হলো সে প্রেমপত্র পাঠাচ্ছে। আর লক্ষ্মী-৫০০ও জবাবে হেডলাইট জ্বালিয়ে সংকেত দিল।

গ্রামজুড়ে হৈচৈ। সবাই বলতে লাগল, “আরে, দুই ট্রাক্টরের প্রেম শুরু হইছে!”

এখন থেকে কী হলো জানেন? প্রতিদিন বিকেলে কুদ্দুস লুকিয়ে ট্রাক্টর নিয়ে যায় করিম মাস্টারের বাড়ির কাছে, যেন দেখা হয় প্রেমিকার সঙ্গে।

গ্রামের ছেলেপেলেরা গান গেয়ে ওঠে,
“ট্রাক্টরের প্রেমে পাগল কুদ্দুস ভাই,
চালক বাদল নাচে, মুরুব্বিরা চায় চা।”

কুদ্দুস কিছুতেই বিশ্বাস করে না ট্রাক্টরের প্রেমের গল্প। সে বলে, “এ সবই গুজব! আমি শুধু ব্যবসার জন্য ট্রাক্টর কিনছি।”

কিন্তু এক রাতে ঘটনা ফাঁস হয়ে গেল। ট্রাক্টরটাকে উঠানে বেঁধে রাখা হয়েছিল, হঠাৎ সে হর্ন বাজাতে লাগল, আলো ঝলমল করতে লাগল। আশেপাশের লোকজন দৌড়ে এল। দেখা গেল, পাশের গ্রাম থেকে করিম মাস্টারও ট্রাক্টর নিয়ে এসেছে। দুই ট্রাক্টর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আলো দিচ্ছে, হর্ন দিচ্ছে— যেন প্রেমিক-প্রেমিকা রাতের চাঁদনীতে গান গাইছে।

এবার আর হাসি থামানো গেল না। মুরুব্বিরা চিৎকার করে বলল, “এই কুদ্দুস, তোমার ট্রাক্টর তো প্রেমে পইরা গেছে! এখন তুমি কী করবা?”

কুদ্দুস মাথা চুলকে বলল, “আমি তো বিয়া দিমু ঠিকই, কিন্তু কনের গায়ের হলুদ কই পামু?”

শেষমেশ গ্রামে একটা অদ্ভুত আয়োজন হলো— দুই ট্রাক্টরের বিয়ে। লাল-সবুজ কাপড় দিয়ে সাজানো হলো, মাইক ভাড়া হলো, ঢাক বাজল, গ্রামের সবাই ভোজ খেল।

আর কুদ্দুস? সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের ট্রাক্টরকে বলল,
“যা রে, সুখে থাকিস। আমি বিদেশে দশ বছর কাটাইছি, তুই এক সপ্তাহেই বউ পাইছিস।”

এইভাবে চরগাঁও গ্রাম নাম পেল— “ট্রাক্টরের প্রেমের গ্রাম।”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!