নওগাঁ জেলার এক শান্ত গ্রাম। সেখানে কুদ্দুস সাহেব নামে এক লোক থাকতেন। লোকজন তাঁকে বলত “বিদেশপ্রেমী কুদ্দুস”, কারণ তিনি সারাক্ষণই বিদেশ যাওয়ার গল্প শোনাতেন। কখনও বলেন,
“আমার এক চাচাত ভাই লন্ডনে ট্যাক্সি চালায়।”
কখনও বলেন,
“আমার ফুপাত ভাইয়ের শালা দুবাইতে বিল্ডিং বানায়।”
গ্রামের লোকেরা শুনে হা করে তাকায়, আর কুদ্দুস গর্বে বুক ফুলিয়ে বলেন,
“আমিও যাব বিদেশ, দেখো না!”
কিন্তু সমস্যা হলো— কুদ্দুসের পড়াশোনা ক্লাস ফোরে শেষ, ইংরেজি বলতে পারেন কেবল “গুড মর্নিং” আর “ওকে বাবু।”
টাকা-পয়সাও তেমন নেই। তবুও বিদেশ যাওয়ার নেশা এমনভাবে মাথায় ঢুকল যে দিনরাত তিনি স্বপ্ন দেখতে লাগলেন।
একদিন তিনি চায়ের দোকানে বসে হঠাৎ বলে উঠলেন,
“শোন মিয়া, আমি বিদেশ যাচ্ছি।”
সবাই হাসতে হাসতে বলল,
“কই টাকা? কই পাসপোর্ট?”
কুদ্দুস গম্ভীর মুখে বললেন,
“সব হবে, ইনশাআল্লাহ। তবে আমি একা যাচ্ছি না।”
লোকজন চমকে গেল।
“তাহলে কার সাথে?”
তিনি নিচু স্বরে বললেন,
“আমার মুরগির সাথে।”
হ্যাঁ, সত্যিই। কুদ্দুসের উঠোনে একটা দেশি মুরগি ছিল, নাম— “লালমনি।” এই মুরগিটা এত ডিম দিত যে পাড়ার মহিলারা পর্যন্ত তার ডিম নিতে লাইন দিত। কুদ্দুসের মনে হলো, বিদেশে গেলে লালমনি তাকে অনেক উপকার করবে।
তাই শুরু হলো মুরগির বিদেশযাত্রার প্রস্তুতি।
প্রথমে তিনি মুরগির জন্য আলাদা একটা ব্যাগ সেলাই করালেন। ব্যাগে ছোট ছোট ছিদ্র করে দিলেন, যাতে লালমনি নিঃশ্বাস নিতে পারে। তারপর গ্রামের দর্জিকে ডেকে মুরগির জন্য বানালেন একটা লালচে জামা, গলায় ঝোলালেন একটা নকল পাসপোর্ট।
লোকজন দেখেই হেসে লুটোপুটি।
“কুদ্দুস, মুরগিও কি বিমানে ওঠে?”
তিনি গম্ভীর হয়ে উত্তর দিলেন,
“সবাই উঠে, তবে ভদ্রভাবে তুলতে হয়।”
দিন ঠিক হলো— কুদ্দুস ঢাকা যাবে পাসপোর্ট করতে। সঙ্গে যাবে লালমনি।
বাসস্ট্যান্ডে যখন কুদ্দুস দাঁড়ালেন, লোকজন অবাক। ব্যাগের ভেতর থেকে মুরগির ডাক ভেসে আসছে,
“কুঁক কুঁক কুঁকু…”
ড্রাইভার গম্ভীর হয়ে বলল,
“ভাই, বাসে মুরগি তোলা যাবে না।”
কুদ্দুস বলল,
“ও মুরগি না, ও আমার ভ্রমণসঙ্গী।”
অবশেষে অনেক বোঝানোর পর মুরগিসহ বাসে উঠতে পারলেন। ঢাকা পৌঁছে কুদ্দুস গেলেন পাসপোর্ট অফিসে। লাইনে দাঁড়িয়ে সবাই ফর্ম পূরণ করছে, ছবি তুলছে। কুদ্দুস ফর্ম জমা দিলেন নিজের আর মুরগির নামে আলাদা করে। অফিসার ভুরু কুঁচকে বললেন,
“এটা কী লিখেছেন? নাম— লালমনি বেগম? পিতার নাম— কক কক?”
কুদ্দুস নির্লজ্জ মুখে বললেন,
“স্যার, ও আমার মুরগি, তবে ও আমার মেয়ে সমান। ওকেও নিতে হবে।”
অফিসার চেয়ার থেকে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলেন হাসতে হাসতে।
“ভাই, বাংলাদেশে এখনো মুরগির পাসপোর্ট হয় না।”
তবে কুদ্দুস হাল ছাড়ার পাত্র না। তিনি বললেন,
“তাহলে ভিসা না হোক, অন্তত টোকেন দিন। আমি পরে আবেদন করব।”
ফলাফল হলো— পাসপোর্ট অফিস থেকে তাকে বের করে দেওয়া হলো। কিন্তু কুদ্দুস হাল ছাড়লেন না।
তিনি এখনো গ্রামের হাটে হাটে ঘুরে বেড়ান, সবাইকে বলেন,
“শোনেন, একদিন আমি লালমনিকে নিয়ে দুবাই যাব। তখন তোমরা হিংসে করবে।”
লালমনি এখনো প্রতিদিন ডিম দেয়। আর গ্রামবাসী হাসতে হাসতে বলে,
“কুদ্দুস ভাই, আগে মুরগির ডিম বেচে ভিসার টাকা জোগাড় করেন, তারপর বিদেশ যান।”