কুয়েতে প্রবাসীদের ভিসা আইনে নতুন পরিবর্তন: যা জানা প্রয়োজন

0



কুয়েত সিটি, ১৭ সেপ্টেম্বর: কুয়েতের জনসংখ্যায় ভারসাম্য আনা এবং শ্রম বাজারকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে, দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পাবলিক অথরিটি ফর ম্যানপাওয়ার (PAM) প্রবাসীদের জন্য প্রযোজ্য বিভিন্ন ভিসা আইনে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে। নতুন এই নিয়মাবলী পারিবারিক ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট এবং নির্দিষ্ট কিছু পেশার যোগ্যতার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে, যা দেশটিতে কর্মরত লক্ষ লক্ষ প্রবাসী, বিশেষ করে বাংলাদেশি কমিউনিটির উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

কর্মকর্তারা বলছেন, এই পরিবর্তনগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো দেশের অভ্যন্তরে অদক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা কমানো, স্থানীয় নাগরিকদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা এবং শুধুমাত্র উচ্চ-দক্ষ এবং প্রয়োজনীয় পেশার কর্মীদের আকৃষ্ট করা।

পারিবারিক ভিসার শর্তাবলী আরও কঠোর

নতুন নিয়মাবলীর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনটি এসেছে পারিবারিক ভিসা বা 'ফ্যামিলি আকামা' (Article 22) সংক্রান্ত নীতিমালায়। পূর্বে, যে সকল প্রবাসী মাসে কমপক্ষে ৫০০ কুয়েতি দিনার বেতন পেতেন, তারা তাদের স্ত্রী এবং সন্তানদের জন্য ফ্যামিলি ভিসার আবেদন করতে পারতেন।

  • নতুন বেতনসীমা: সংশোধিত আইন অনুযায়ী, ফ্যামিলি ভিসার জন্য আবেদন করতে হলে এখন থেকে একজন প্রবাসী কর্মীর মাসিক ন্যূনতম বেতন হতে হবে ৮০০ কুয়েতি দিনার। এই বেতন অবশ্যই তার সরকারী 'ইজনে আমাল' বা ওয়ার্ক পারমিটে উল্লেখ থাকতে হবে।

  • প্রভাব: এই সিদ্ধান্তের ফলে, বহু প্রবাসী, বিশেষ করে যারা ৮০০ দিনারের কম বেতনে চাকরি করেন, তারা তাদের পরিবারকে কুয়েতে নিয়ে আসার বা রাখার যোগ্যতা হারাবেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এর ফলে অনেক পরিবার বিভক্ত হয়ে পড়তে পারে এবং বহু প্রবাসী তাদের পরিবারকে নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে বাধ্য হতে পারেন, যা তাদের মানসিক এবং সামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলবে।

  • ব্যতিক্রম: তবে, নির্দিষ্ট কিছু পেশার ক্ষেত্রে এই বেতনের শর্ত শিথিলযোগ্য থাকবে। সরকারি খাতের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিচারক, অধ্যাপক এবং অন্যান্য উচ্চ-দক্ষ পেশাজীবীরা এই নিয়মের আওতার বাইরে থাকবেন বলে জানা গেছে।

ওয়ার্ক পারমিট এবং পেশা পরিবর্তনে নতুন নিয়ম

শ্রম বাজার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে, ওয়ার্ক পারমিট (Article 18) ইস্যু এবং এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানিতে আকামা স্থানান্তর বা 'তানাজুল' (Transfer) প্রক্রিয়ায়ও কিছু নতুন শর্ত আরোপ করা হয়েছে।

  • দক্ষতার সনদ: নির্দিষ্ট কিছু টেকনিক্যাল এবং কারিগরি পেশার জন্য এখন থেকে ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু বা রিনিউ করার সময় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষতার সনদ বা ট্রেড সার্টিফিকেট জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হতে পারে। এই সনদগুলো কুয়েতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্বারা যাচাই করা হবে। এর উদ্দেশ্য হলো, অদক্ষ কর্মীদের এই সব পেশায় প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখা।

  • কোম্পানি পরিবর্তনে সীমাবদ্ধতা: নতুন নিয়মে, একজন কর্মীর জন্য প্রথম কাফিল বা স্পন্সরের অধীনে কমপক্ষে তিন বছর কাজ করার পরই আকামা স্থানান্তর করার সুযোগ থাকবে। পূর্বে এই সময়সীমা ক্ষেত্রবিশেষে এক বছর ছিল। এই নিয়মটি ঘন ঘন চাকরি পরিবর্তন করার প্রবণতা কমাবে বলে কর্তৃপক্ষ মনে করছে।

  • 'স্মল এন্টারপ্রাইজ' ভিসার উপর কড়াকড়ি: ছোট ছোট ব্যবসা বা 'স্মল এন্টারপ্রাইজ'-এর নামে ইস্যু করা ভিসাগুলোর উপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। অনেক সময় এই ধরনের ভিসা ব্যবহার করে শ্রমিকদের কুয়েতে এনে অন্য জায়গায় অবৈধভাবে কাজে লাগানো হয়, যা 'ভিসা ট্রেডিং' নামে পরিচিত। এই ধরনের কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য এখন থেকে ছোট কোম্পানিগুলোর ফাইল এবং তাদের প্রকৃত কার্যক্রম কঠোরভাবে নিরীক্ষা করা হবে।

কেন এই পরিবর্তন?

কুয়েতের সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, এই পদক্ষেপগুলো 'ভিশন ২০৩৫'-এর অংশ, যার লক্ষ্য হলো কুয়েতের অর্থনীতিকে তেল-নির্ভরতা থেকে বের করে এনে একটি জ্ঞান-ভিত্তিক এবং বৈচিত্র্যময় অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করা।

  • জনসংখ্যার ভারসাম্য: বর্তমানে কুয়েতের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশই প্রবাসী। সরকার এই অনুপাতটিকে কমিয়ে এনে স্থানীয় এবং প্রবাসী জনসংখ্যার মধ্যে একটি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

  • স্থানীয়দের কর্মসংস্থান: নতুন নিয়মগুলো বেসরকারি খাতে কুয়েতি নাগরিকদের নিয়োগ বা 'কুয়েটাইজেশন' প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করবে।

  • শ্রম বাজারের মানোন্নয়ন: অদক্ষ শ্রমিকের পরিবর্তে উচ্চ-দক্ষ এবং পেশাদার কর্মীদের আকৃষ্ট করার মাধ্যমে সরকার দেশের সামগ্রিক শ্রম বাজারের মান উন্নত করতে চায়।

বাংলাদেশি কমিউনিটির উপর সম্ভাব্য প্রভাব

কুয়েতে কর্মরত বিশাল বাংলাদেশি কমিউনিটির একটি বড় অংশই নির্মাণ, পরিচ্ছন্নতা এবং সেবা খাতের মতো স্বল্প বেতনের চাকরিতে নিয়োজিত। নতুন এই নিয়মাবলী, বিশেষ করে পারিবারিক ভিসার বেতনসীমা বৃদ্ধি, তাদের উপর সরাসরি এবং গুরুতর প্রভাব ফেলবে। অনেক পরিবারই এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। কমিউনিটির নেতারা বলছেন, তারা বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে কুয়েতি কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার চেষ্টা করবেন, যাতে মানবিক দিকগুলো বিবেচনা করে এই নিয়মগুলো প্রয়োগ করা হয়।

প্রবাসী কর্মীদের এখন তাদের কাগজপত্র এবং চুক্তির শর্তাবলী সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন হতে হবে এবং নতুন নিয়ম অনুযায়ী নিজেদের অবস্থান মূল্যায়ন করতে হবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!